Only I know what is my goal, My heart is my temple.
কাজী সায়েমুজ্জামান:
১৯৯০ সালে পাওনা আদায়ের জন্য মামলাটি চুয়াডাঙ্গার জেনারেল সার্টিফিকেট
অফিসারের কাছে দায়ের করা হয়েছিল। প্রায় ২২ বছর পর ৯ জুলাই পুরো ঋণ আদায় করে
এ মামলাটি নিষ্পত্তি করলাম। আসল দেনাদারের মৃত্যুর পর তাঁর ওয়ারিশদের কাছ
থেকে ঋণ আদায়ের মাধ্যমে মামলাটির সমাপ্তি হলো। এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে খাতকের
ওয়ারিশদের মালামাল ক্রোক থেকে শুরু করে বন্ধককৃত স্থাবর সম্পত্তি নিলাম
করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্রোকের মালামাল আত্মসাৎ করার কারণে জিম্মাদারের
বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে সিআর মামলাও দায়ের করা হয়। এর পরও আদায় হয়নি
পুরো অর্থ।
দেনাদারের ওয়ারিশরা অজ্ঞাত ঠিকানায় চলে গেলে ঋণ আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। এর
মধ্যে এ মামলার আদেশ, বাদীর হাজিরা, বিভিন্ন প্রতিবেদন নথির সঙ্গে যুক্ত
হয়ে ফুলেফেঁপে নথির ওজন বেড়ে কয়েক কেজি হয়ে যায়। দেনার মূল দাবি ১৫ হাজার
১৩১ টাকা আদায় করতে এক হাজার ৩০০ টাকার কোর্ট ফিসহ কয়েক শ টাকার কাগজও
ব্যবহার করতে হয়। চিঠি চালাচালি হয়েছে কয়েক শ।
অবশেষে আমি উদ্যোগ নিই। যে করেই হোক মামলাটির নিষ্পত্তি করতে হবে। খাতকের
ওয়ারিশদের অবস্থান জানতে লোক লাগিয়ে দিই। জানতে পারি, তাঁদের অর্থনৈতিক
অবস্থা এখন ভালো। শুধু দেনা পরিশোধের অনিচ্ছা আর উদাসীনতার কারণেই দেনা
অপরিশোধিত আছে। এর পরই চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি।
কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয়। অবশেষে মরহুম খাতকের দুই ছেলের গ্রেপ্তার আর বাকি
চার হাজার ১৩১ টাকা আদায়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় মামলাটি। মামলার খাতক বা
দেনাদার ছিলেন একজন মহিলা। নাম ফয়জুুন্নেছা। তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার
বোয়ালিয়া গ্রামে। তিনি পূবালী ব্যাংক, চুয়াডাঙ্গা শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।
ওই ঋণ শোধ না করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরকারি পাওনা আদায় আইন-১৯১৩, যা সবার
কাছে পিডিআর অ্যাক্ট হিসেবে পরিচিত, এর আলোকে ফয়জুন্নেছার বিরুদ্ধে
সার্টিফিকেট অফিসারের কাছে একটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে। সার্টিফিকেট
অফিসার আইনের ৪৮ ধারা মোতাবেক একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারূপে গণ্য। ৪৯
ধারামতে, এই আদালত দেওয়ানি আদালত হিসেবে কাজ করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০
সালে সার্টিফিকেট অফিসার ফয়জুন্নেছার বিরুদ্ধে আইনের ১০(ক) ধারায় নোটিশ
জারি করে তাঁকে ৩০ দিনের মধ্যে দেনা পারিশোধের নির্দেশ দেন।
আমি চুয়াডাঙ্গার সার্টিফিকেট অফিসার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে গত ২১ মে এ
মামলার নথিটি হাতে পাই। আদালত সহকারীর তথ্যে জানতে পারি, এ পর্যন্ত ১১
হাজার টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। সেটা ১০ বছর আগের কথা। বাকি টাকা আদায়
করা সম্ভব হয়নি। নথির একেকটি পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করি। ২২ বছরের একটি
মামলার পোস্টমর্টেম আমার সামনে ভেসে ওঠে। এর কিছু অংশ আবেগমাখা আবার কিছু
অমানবিক। আছে শঠতার উপাদানও। আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। দেখা যায়, মামলা দায়েরের
দুই বছর পর ১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট সার্টিফিকেট অফিসার দেনাদারের মালামাল
ক্রোক করার জন্য আদেশ দেন। দেওয়ানি কার্যবিধির ৬০ ধারা মোতাবেক পিডিআর
অ্যাক্টের ১৭ ধারায় দেনাদারের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। ক্রোক করা
সম্পত্তি বিক্রি করে দেনার অর্থ আদায় করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্রোক করতে
গিয়েই জানা গেল, দেনাদার ফয়জুন্নেছা আর নেই। ১৯৯২ সালের ২৯ নভেম্বর সহকারী
নাজির আদালতকে জানান, ক্রোক তামিল করতে গিয়ে জানা যায় তিনি এক বছর আগেই
মারা গেছেন। এ পর্যন্ত দেখেই সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক তাঁর ওয়ারিশদের
কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করে দেনাদারের আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। কারণ
হাদিসে রয়েছে, আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করে দিতে পারেন, কিন্তু কর্জ পরিশোধ না
করা পর্যন্ত তা মাফ করা হয় না।
দেনাদারের মৃত্যুতে থেমে যায় ক্রোকের কার্যক্রম। তাঁর ওয়ারিশদের খোঁজখবর
নেওয়া শুরু হয়। কারণ আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী দেনাদার মারা গেলে তাঁর
আইনানুুগ প্রতিনিধির ওপর এর দায় বর্তিত হয়। ফয়জুন্নেছার ওয়ারিশদের খুঁজে
পেতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দুই বছর লেগে যায়। ১৯৯৪ সালের ১০ আগস্ট ব্যাংক
কর্তৃপক্ষ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রদত্ত ওয়ারিশনামা আদালতে দাখিল
করেন। এতে দেখা যায়, ফয়জুন্নেছা চার ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন। ফলে মায়ের
দেনা তাঁদের ওপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু এক ছেলে ভারতে আরেকজন অজ্ঞাতস্থানে চলে
যান। দুই ছেলে আবু বকর আর আবু লেহাজ_এ দুজনকেই দেনা পরিশোধের জন্য নির্ধারণ
করে ব্যাংক। সার্টিফিকেট অফিসার তাঁদের নোটিশ দিয়ে আদালতে হাজির হতে
নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা আদালতে হাজির হননি। ফলে তাঁদের অস্থাবর সম্পত্তি
ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ৭ আগস্ট খাতকদের বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার
৫০০ টাকা মূল্যমানের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। এ সম্পত্তি বেগমপুর
গ্রামের নবিছুদ্দিনের ছেলে বাবুল মোল্লার জিম্মায় রাখা হয়। কিন্তু বাবুল
মোল্লা ওই সম্পদের অর্থ আদালতে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। ফলে তাঁর
বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় সিআর ৪৬৫/২০০১ মামলা করা হয়।
অবশ্য এক বছর এ মামলা পরিচালিত হওয়ার পর একপর্যায়ে জামিনদার ওই পরিমাণ
অর্থ আদালতে জমা দেন। ফলে তাঁর মামলা প্রত্যাহারের জন্য সার্টিফিকেট অফিসার
সংশ্লিষ্ট ফৌজদারি আদালতে চিঠি দেন। সার্টিফিকেট অফিসার পাওনা আদায়ের
সর্বশেষ পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেন। ফয়জুন্নেছার বন্ধককৃত সম্পত্তি
নিলামের আদেশ দেওয়া হলো। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করতে গিয়ে দেখা যায়
বিপত্তি। কারণ নিলামের আগে তহসিলদারের কাছ থেকে জমির তফসিলেরও প্রতিবেদন
সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা যায়, দেনাদার সব সম্পত্তিই বিক্রি করে দিয়েছেন।
শুধু ভিটের জমিটুকু বাকি রয়েছে। আইন অনুযায়ী কাউকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ
করা যায় না। ফলে স্থাবর সম্পত্তি আর নিলাম করা যায়নি। দিনের পর দিন দেনা
পরিশোধের জন্য দেনাদারকে তাগিদই দিতে হয়েছে। অবশেষে ২০০৯ সালের ১৯ এপ্রিল
দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন সার্টিফিকেট অফিসার।
কিন্তু পুলিশ তা তামিল করেনি। যদিও পিআরবি অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
তামিল না হলে তার কারণ উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানোর বিধান রয়েছে।
পরোয়ানা তামিলের প্রতিবেদন না পেয়ে আদালত ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি ধার্য
তারিখে পুলিশকে পরোয়ানা তাগিদের পত্র দিয়ে যান।
আমি নথিটি পেয়ে দুই খাতকের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে ব্যাংকের
ব্যবস্থাপককে নির্দেশ দিই। কয়েক দিন পর তিনি জানান, তাঁদের একজন আইনজীবীদের
সহকারী হিসেবে কাজ করেন। একটু এগিয়ে গেলাম। অন্য একজন জানালেন, দেনাদার
ভ্রাম্যমাণ হিসেবে কাজ করেন। আদালত এলাকায় তাঁর কোনো স্থায়ী আসন নেই। আমি
এক মাস ধরে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হই। জানতে পারি, তাঁর অর্থনৈতিক
অবস্থা এখন ভালো। গ্রেপ্তার হলেই মায়ের ঋণ শোধ করতে পারবেন। আমি সদর থানার
ওসিকে ফোন করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিই। বলে দিই,
ব্যাংকের গাড়িতে পুলিশ গিয়ে যেন খাতকদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। কিন্তু
প্রথম অভিযান ব্যর্থ হয়। খাতকের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করি। ওসিকে আবার ফোন
দিই। তিনি এএসআই সিরাজকে খাতকদের গ্রেপ্তারের পরোয়ানা তামিলের দায়িত্ব দেন।
এএসআই সিরাজ অবশেষে সফল হলেন। গত ২৮ জুন খাতকদের গ্রেপ্তার করে আদালতে
সোপর্দ করা হয়। তাঁদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। হয় দেনা পরিশোধ, নয়তো
সিভিল কারাগারে গমন। কারাবন্দি হওয়ার পর প্রত্যেক বন্দির পেছনে দৈনিক খরচ
হয় ২৬ টাকা, যা প্রাথমিক অবস্থায় মামলার বাদীকেই জেল সুপার বরাবর পরিশোধ
করতে হয়। এ টাকাও মূল দেনার সঙ্গে যুক্ত করে দেনাদারের কাছ থেকে আদায় করা
হয়। দুই ভাই দেনা দিতে রাজি হন। আদালতে বসেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে টাকা
দিয়ে দেন। এভাবেই ২২ বছর পর একটি দেনার গল্প শেষ হয়।
সক্রেটিস বলেছিলেন, ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা না করে কখনোই ঋণ করো না। কিন্তু
লোকজন আগে-পিছে কিছু না ভেবেই ঋণী হয়ে যায়। সরকারের এ অর্থ যে দিতে হবে তা
বেমালুম ভুলে যায়। আমার দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, অনেকে এ আইন সম্পর্কে
কিছুই জানে না। অথচ এ আইনটির মতো এত অমানবিক এবং কঠিন আইন এ দেশে অন্যটি
রয়েছে কি না সন্দেহ। দেনা পরিশোধ না করা পর্যন্ত কখনোই এটি শেষ হয় না।
বংশপরম্পরায় এ মামলাটি চলতে থাকে। আলোচ্য মামলায় মায়ের দেনার জন্য দুই ছেলে
গ্রেপ্তার হয়েছেন। অবশেষে দেনা দিতে বাধ্য হয়েছেন। গাজী শামছুর রহমান তাঁর
সরকারি পাওনা আদায় আইনের ভাষ্য বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, সরকারি দাবি
পরিশোধ না করার অর্থ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করা। এ টাকা ফাঁকি দেওয়ার
কোনো উপায় নেই। ঋণ করার শুরুতেই এ কথা মনে রাখলে ঋণ পরিশোধে কারো কষ্ট
হওয়ার কথা নয়। তবে কোনো দুর্ঘটনার কারণে কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে
সার্টিফিকেট অফিসার অবশ্যই বিবেচনা করেন। দীর্ঘদিনের কিস্তিতে পরিশোধের
সুযোগ দেন। আদালতের সেই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে।
লেখক : নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সার্টিফিকেট অফিসার জেলা প্রশাসকের
কার্যালয়, চুয়াডাঙ্গা।
পাওনা আদায় মামলা - ২২ বছর পর নিষ্পত্তি
দৈনিক কালের কন্ঠ, ঢাকা, শনিবার ১৪ জুলাই ২০১২, ৩০ আষাঢ় ১৪১৯, ২৩ শাবান
১৪৩৩
সোর্স: http://www.somewhereinblog.net
সোর্স: http://www.somewhereinblog.net
No comments:
Post a Comment